শিরোনামের শব্দ-খেলাঃ মুসলিমদের বিরুদ্ধে মিডিয়া প্রোপাগান্ডা কীভাবে কাজ করে
Published:
কল্পনা করুন—একই ধরণের হামলা, দুটো আলাদা শিরোনামঃ একটা বলে “Gunman”, আরেকটা বলে “Muslim terrorist।” শব্দ বদলালেই আমরা ঘটনাকে অন্য চোখে দেখি। শুধু অনুমান নয়, গবেষণা বলছে মুসলিম অভিযুক্তদের জড়িত ঘটনার কভারেজ অস্বাভাবিকভাবে বেশি হয়, আর সেই অতিরিক্ত উপস্থিতিই জনমতের ভিত গড়ে দেয়, মানুষের চিন্তাকে বদলে দেয়। ২০০৬–২০১৫ সময়কালে যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম অভিযুক্তদের হামলা গড়ে ৩৫৭% বেশি সংবাদ কভারেজ পেয়েছে। এটা কোনো ব্লগপোস্টের মতামত নয়, পিয়ার-রিভিউড স্টাডির ফলাফল। (Taylor & Francis Online)
মিডিয়া যে ব্যপারগুলো সামনে আসতে দেয় না
- কভারেজের বৈষম্যঃ উপরের গবেষণাই দেখায় হামলায় নিহতের সংখ্যা বা সরকারকে লক্ষ্যবস্তু করা এসব ফ্যাক্টর কভারেজ বাড়ালেও, অভিযুক্তের ধর্ম ছিল সবচেয়ে বড় প্রেডিক্টর। অর্থাৎ মুসলিম হলে খবরের পরিমাণ বেড়ে যেত। (Taylor & Francis Online)
দুঃখজনক হলেও সত্য, এমনটা শুধু আমেরিকা বা অমুসলিম দেশগুলোতে না, মুসলিম দেশগুলোও এখন অভ্যন্তরীন মিডিয়া প্রোপাগান্ডার শিকার। আমাদের দেশেই দেখুন, মুসলিম বা হুজুর সমাজ কোন অপরাধ করলে সেক্যুলার গোষ্ঠী সেটা ফলাও করে প্রচার করে, সবাই জেনে যায়। কারণ বেশিরভাগ বড় মিডিয়া তাদের দখলে। অপরদিকে হিন্দু বা ইসলাম-বিরোধী কেউ কোন অপরাধ করলে সেটা ধামাচাপা পড়ে যায়। কারণ মুসলিম কমিউনিটি বা হুজুর সমাজ প্রচারবিমুখ, আর তাদের হাতে বড় কোন মিডিয়ার একসেসও নাই।
- নিজেদের কুকর্ম গোপন করাঃ আমেরিকায় শুধুমাত্র ২০২২ সালেই ৪৮,০০০ মানুষ গান-শটে নিহত হয়েছে, যা দৈনিক দাঁড়ায় প্রায় ১৩২ জন। বিপরীতে কোন মুসলিম দেশে আপনি এর ধারের কাছেও পাবেন না। (CDC)
এটা সোশ্যাল সিকিউরিটি নিয়ে আমাদের হীনমন্যতার বহিঃপ্রকাশ। আমরা মুসলিমরাই পশ্চিমা মানবতা, উন্নয়ন আর চাকচিক্যের গোলাম হয়ে গেছি। তাদের বুলিকে আমাদের আদর্শ হিসেবে মেনে নিয়েছি। যার কারণে একটা মেন্টাল বায়াসনেস আমাদের মনে ঠাঁই করে নিয়েছে। আমরা আমাদের দোষ, সমস্যা, কমতি; এগুলো নিয়েই পড়ে থাকি। তাদের অমানবিকতা-সমস্যা আমাদের চোখে পড়ে না।
- টিভি কাভারেজের টোনঃ যুক্তরাষ্ট্রে ইসলাম/মুসলিম বিষয়ে টিভি কভারেজের ৮০%–এরও বেশি নেতিবাচক, যা জনধারণায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। (ISPU)
এই সম্পর্কে আগেই বলেছি, মিডিয়ায় মুসলিমদের অর্জনকে ম্লান করে দেয়া হয় সেই আদিকাল থেকেই। বিপরীতে কুকীর্তিগুলো সামনে নিয়ে আসা হয় আর বিশ্ববাসীকে সেটাই বিশ্বাস করানো হয়।
- পাবলিকের বিচারঃ আমেরিকায় অর্ধেকেরও বেশি প্রাপ্তবয়স্ক বলেন, মিডিয়ার মুসলিম/ইসলাম কভারেজ ন্যায্য নয়। (Pew Research Center)
উন্নত দেশগুলোতে মূলত জনগনকেই বোকা বানানো হয়। ক্ষমতার মসনদে বসে নেতারা বড় বড় লেকচার দেয়, ট্যাক্সের টাকা নিজেদের ক্ষমতা বলবৎ রাখতে ব্যবহার করে, আর রাতকে দিন বানিয়ে জনগনের কাছে উপস্থাপন করে। ফ্রীডম-অব স্পিচ, জনগনের স্বাধীনতা, নিজ নিজ ধর্মীয় স্বাধীনতা সম্পর্কিত যেসব বুলি আওরায়, সেগুলো যে মিথ, অনেক জনগনের কাছে তা অজানা নয়।
প্রোপাগান্ডা সাধারণত যেভাবে কাজ করে
- লেবেলিং-এর ডাবল স্ট্যান্ডার্ডঃ মুসলিম অভিযুক্ত হলে “Islamic” বা “Muslim” ট্যাগ শিরোনামে হাইলাইটেড হয়ে উঠে আসে, আর অ-মুসলিম হলে সেখানে ধর্ম প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়। একাধিক গবেষণায় দেখা যায় “terrorist” শব্দটি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও এমন পার্থক্য ঘটে। (International Journal of Communication)
- চেরি–পিকিং ও পুনরাবৃত্তিঃ সিলেক্টেড কয়েকটি ঘটনা বারবার দেখিয়ে একটা কমিউনিটিকে মোটের ওপর “ঝুঁকি” হিসেবে ফ্রেম করা হয়। যার ফলে বাস্তবতা আড়ালে পড়ে যায়, ভয় সামনে আসে। (MDPI)
- “সিঙ্গেল স্টোরি” সিনড্রোমঃ ১–২জন বক্তা/ক্লিপকে পুরো মুসলিম কমিউনিটির প্রতিনিধি বানিয়ে দেওয়া, এটা মিডিয়ার পুরনো প্রবণতা, যা বৈচিত্র্যকে অদৃশ্য করে। (MDPI)
- ডেটা ছাপিয়ে আবেগঃ কনটেক্সট (তারিখ, সংখ্যা, উৎস) বাদ দিয়ে আবেগী ভিজ্যুয়াল/ভাষায় “বড়ো গল্প” বানানো, এভাবেই সাধারণ জনগনকে বোকা বানিয়ে সত্যকে ধামাচাপা দেয়া হয়। (Portal)
কেন এই আলোচনা আজও দরকার
গ্লোবাল টেররিজম ট্রেন্ডে দেখা গেছে—পশ্চিমে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডানপন্থী সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে, মুসলিম–অতিবাদীদের হামলা তুলনায় কমেছে; কিন্তু জনআলোচনায় এই পরিবর্তন যথেষ্ট প্রতিফলিত হয় না। মিডিয়ার সিলেক্টিভ কভারেজ ও ভাষার খেলা এতে বড় ভূমিকা রাখে। (Perspectives on Terrorism)
এছাড়া আমাদের দেশেও, আমরা মুসলিম-প্রধান হলেও সেক্যুলাররা আমাদের প্রধান শত্রু হয়ে উঠেছে। কারণ তাদের হাতে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা অনেক। আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও নিজেদের দুর্বলতা আর বাইরের প্রোপাগান্ডার কারণে প্রতিনিধিত্ব করতে পারছি না। যার কারণে মুসলিমরা দারুণভাবে এই মিডিয়া প্রোপাগান্ডার শিকার হচ্ছে প্রায়শই।
শেষ কথাঃ আমরা কী করতে পারি?
মিডিয়া একাই জনমত বানায় না; আমরাও ক্লিক/শেয়ার দিয়ে সিদ্ধান্ত নিই কোন গল্পগুলো বেঁচে থাকবে। তাই শব্দের রাজনীতি ধরার চেষ্টা করুন, ডেটার উৎস চান, আর যেখানেই দেখবেন মুসলিম পরিচয় প্রাসঙ্গিকতা ছাড়াই টেনে আনা হচ্ছে, সেখানে প্রশ্ন তুলুন। আপনার আশেপাশের সবাইকে সাধ্যমত সচেতন করে তুলুন।
বিস্তারিত জানুনঃ
- Kearns, Betus & Lemieux (2019): মুসলিম অভিযুক্ত হলে কভারেজ ৩৫৭% বেশি—এই ফলাফল বহু সেকেন্ডারি বিশ্লেষণেও উদ্ধৃত। (Taylor & Francis Online)
- Ipsos “Perils of Perception”: ইউরোপে মুসলিম জনসংখ্যা নিয়ে ধারনার বড় ফারাক। (Ipsos)
- Pew Research: অনেক আমেরিকান মনে করেন—মিডিয়ার মুসলিম/ইসলাম কভারেজ ন্যায্য নয়। (Pew Research Center)
- US Centres for Dsease Control and Prevention: আমেরিকায় দৈনিক গড়ে ১৩২ জন অস্ত্রের মুখোমুখী মৃত্যবরণ করে। (CDC)
- ISPU Journalist Toolbox: ব্যালান্সড কভারেজের জন্য ব্যবহারিক গাইড। (ISPU)
- PEN America, Council of Europe: মিডিয়া-লিটারেসি চেকলিস্ট/রিসোর্স। (PEN America)